চট্টগ্রামে মিতু হত্যাকাণ্ড; পাঁচ বছর পর স্বামী কেন আসামী
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি;
চট্টগ্রামের আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছরের মাথায় তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়া কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসাকে ঘটনার পর তিন লাখ টাকাও দিয়েছেন বাবুল, যেটাকে ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ বলছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তারকে তার দীর্ঘদিনের সোর্স মুসার ছবি দেখানো হলে তাকে শনাক্ত না করে কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালায় বাবুল।
এসব কারণে স্ত্রী হত্যায় মামলার বাদী থেকে প্রধান আসামি হয়েছেন তিনি। পিবিআই কর্মকর্তাদের ভাষ্য- বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। জিজ্ঞাসাবাদে পারিবারিক কলহের কথা স্বীকার করলেও কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড তা নিয়ে এখনও মুখ খোলেননি তিনি।
প্রসঙ্গত; ২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ের কাছে ওআর নিজাম রোডে নির্মমভাবে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ছুরিকাঘাত ও গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বাবুল আক্তার অজ্ঞাত পরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এর আগে সেটি নগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করেছিল। নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন বাবুল আক্তার। হত্যাকাণ্ডের এক মাস আগে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগদান করেন তিনি।
আদালতে দেওয়া পিবিআইর চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও তদন্ত সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালে মিতু হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে বাবুল আক্তারের আর্থিক লেনদেন পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেখানে মিতু হত্যার তিন দিন পর তিন লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পায় পিবিআই। টাকাগুলো বাবুল আক্তারের নির্দেশে কাজী আল মামুনের কাছে পাঠান তার বন্ধু সাইফুল হক। মামুন তিন লাখ টাকা মুসাকে দেন। পিবিআই এ বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর সাইফুল ও মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
গত ১১ মে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালতে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মুসাকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। একেকবার একেক তথ্য দিয়ে তিনি বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন বলেও তদন্ত কর্মকর্তারা জানান।
পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, বিকাশের মাধ্যমে এই টাকা লেনদেন হয়েছে। বিকাশের লেনদেনের তথ্য আমরা উদ্ধার করেছি। তদন্তে এটা নিশ্চিত হয়েছি যে হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার তার প্রতিশ্রতি অনুযায়ী টাকাগুলো মুসার কাছে পাঠিয়েছেন।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, বাবুল আক্তারের সোর্স মুসাকে ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট চেনা গেছে। কিন্তু তদন্তে ও জিজ্ঞাসাবাদে মুসাকে নিয়ে বাবুল আক্তার কোনো সন্দেহের কথা বলেননি। পরে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি, বাবুল আক্তার ইচ্ছাকৃতভাবে তার ব্যক্তিগত সোর্স মুসাকে নিয়ে পুলিশকে কিছু জানায়নি।
কে এই গায়ত্রী অমর সিং; পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে মিতুর বাবা মোশাররফ অভিযোগ করেন, কক্সবাজারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন বাবুল আক্তার আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তা ভারতীয় নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। বিষয়টি জেনে যাওয়ার পর মিতুর সঙ্গে তার দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। এজাহারে আরও বলা হয়, বাবুল আক্তারের মোবাইলে পাঠানো গায়ত্রীর ২৯টি মেসেজ খুনের শিকার হওয়ার আগে মিতু তার ব্যবহূত একটি খাতায় লিখে রেখেছে। এছাড়া বাবুল আক্তারকে গায়ত্রীর উপহার হিসেবে দেওয়া দুটি বইয়ে তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের কিছু তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।
এ বিষয়ে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, মিতুর খাতা ও বাবুলকে উপহার হিসেবে দেওয়া দুটি বই আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। বাবুল আক্তারকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলে প্রয়োজনে ওই নারীর কর্মস্থলে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। বিদেশি সংস্থায় কর্মরত ভারতীয় ওই নারী এখন বাংলাদেশে না থাকলেও তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালাবেন বলে জানান তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খুলছেন না বাবুল আক্তার; মিতুর বাবার দায়ের করা মামলায় বাবুল আক্তারকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি মুখ খুলছেন না। গায়ত্রী অমর সিংয়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, তোমরা বিষয়টি তদন্ত করছো, তোমরা যাচাই করে দেখো।
মুসাকে ফেরত চান তার স্ত্রী; কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের অভিযোগ, মিতু হত্যার ১৭ দিন পর গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে মুসাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে পুলিশ শুরু থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। পান্না আক্তার বলেন, এতদিন সন্তানদের নিরাপত্তার ভয়ে মুখ খুলিনি। পাঁচটি বছর স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন কেটেছে। আমার স্বামী বাবুল আক্তার ও প্রশাসনের সোর্স ছিলেন। আমার স্বামী যদি দোষী হয় তাহলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। তাকে আদালতে হাজির করা হোক। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।
পান্না আক্তার বলেন, ২০১৬ সালের ১৮ বা ১৯ জুন মুসার কাছে একটা ফোন আসে। তখন তিনি আমার কাছ থেকে একটু সরে যান। ওই প্রান্ত থেকে কী বলেছে তা শুনিনি। কিন্তু মুসাকে বলতে শুনেছি, আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি হলে আমি মুখ খুলব স্যার। ফোন রেখে দেওয়ার পর মিতু হত্যায় তিনি জড়িত কিনা জানতে চাইলে মুসা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি চাই নাই। আমাকে বাধ্য করা হয়েছে। নয়তো আমাকে বাঁচতে দিত না। আমি সরাসরি ছিলাম না। লোকজন ঠিক করে দিয়েছি। ফোন করা ব্যক্তি বাবুল আক্তার ছিলেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

