গোবিন্দগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস আজ

DBCNEWS24DBCNEWS24
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৬:১৪ AM, ১২ ডিসেম্বর ২০২০

Spread the love

গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি;

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাসের বিভিষিকাময় দিন শেষে সবুজের মাঝে রক্তলাল পতাকা উড়িয়ে সামগ্রিক বিজয় ছিনিয়ে আনার ৩দিন পূর্বেই গোবিন্দগঞ্জ ও দেশের তৎকালীন বৃহত্তম চিনিকলখ্যাত মহিমাগঞ্জে উড়ে বিজর্য়ে পতাকা। পাক হানাদার মুক্ত হয় গোবিন্দগঞ্জ।
পাকিস্তানী লুটেরা, বেঈমান শোষকদের নির্যাতন আর বিশ্বাসঘাতকতার কবল থেকে মুক্ত হয় এই দিন। আর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল এই জনপদের সকল শ্রেণীর মানুষ। ৭১- এর ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় জাাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, আকাশে- বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্য শহর বন্দর গ্রামের মত গোবিন্দগঞ্জেও এসে পৌঁছে। পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গতে চলে শক্রু মোকাবেলার বিভিন্ন প্রস্তুতি।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যার খবর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে গোবিন্দগঞ্জে এসে পৌঁঁছলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য স্বাধীনতা পাগল আপামর জনতাকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও সংগ্রাম কমিটি গোবিন্দগঞ্জের অদুরে ঢাকা– রংপুর মহাসড়কের কাটাখালী ব্রিজ ধ্বংস করে পাকিস্থানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২৬ মার্চ সারারাত চলে প্রস্তুতি। ২৭ মার্চ সকালে শত শত মুক্তি পাগল তরুণ যুবক ছাত্র জনতা কোদাল , শাবল, হাতুরী, খুন্তি ইত্যাদি নিয়ে ট্রাক যোগে আবার কেউ পায়ে হেঁটে পৌঁছে কাটাখালীতে।
সেখানে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সেতুটি ধ্বংস করতে যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শুরু করে ভাঙ্গার কাজ। সকলের পরিশ্রমে ব্রীজের উত্তর পাশেে কিছু অংশ ভাংগা হলে হঠাৎ রংপুর দিক থেকে পাক বাহিনীর একটি কনভয় ছুটে আসে ব্রীজের কাছে পৌঁছেই এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে মুক্তি পাগল বাঙ্গালীর উপর। এসময় এদিক সেদিক ছুটে পালায় অনেকে। এলোপাতাড়ি গুলির আঘাতে শহীদ হন আবদুল মান্নান আকন্দ, বাবলু মোহন্ত,বাবু দত্ত সহ অজ্ঞাত পরিচয় এক কিশোর ও এক বৃদ্ধ।পরবর্তী স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ই পি আর বাহিনীর সহযোগীতায় ডিনামাইন দিয়ে ব্রীজটি উডিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় গোবিন্দগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সুচনা। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্রীজের পাশের গ্রাম গুলি জ্বালিয়ে দেয।
এরপর কোচাশহর গ্রামে আক্রমন চালিয়ে আকবর সরদার, দুদু সরদারকে হত্যা করে এবং পালপাড়া, কুমিড়াডাঙ্গা, মহিমাগঞ্জ ,জিরাই, গোপালপুর সহ বিভিন্ন গ্রামের, অধিকাংশ বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তারা মহিমাগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসা ও চিনিকলের রেষ্ট হাউসে স্থাপন করে আর্মি ক্যাম্প।
এখানে স্থানীয় রাজাকার দালালদের সহায়তায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের ব্যত্তিদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিমান হামলায় মহিমাগঞ্জ বাজারে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে হত্যা করা হয় অনেক মানুষকে। ৩ আগষ্ট বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আব্দুস সোবহান আকন্দ, আব্দুল কাদের সরকার ও এমদাদ উদ্দীন আকন্দ নামের তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী।
হত্যা করে গুমানীগঞ্জের জয়েন দরবেশ, কাটাবাড়ি ইউনিয়নের হায়দার আলী মাষ্টার এবং নরেশ বর্মন সহ অসংখ্য মানুষকে পাশবিক নির্যাতন করে। এছাড়া গোবিন্দগঞ্জ হাইস্কুল, কুঠিবাড়ি, মহিমাগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসা, চিনিকলের গেষ্টহাউস ও কাটাখালী ব্রীজের হাওয়া খানায় ক্যাম্প স্থাপন করে ব্যাপক গণহত্যা লুটপাট ধর্ষণ শুরু করে পাক হানাদার বাহিনী।
এরমধ্যে হাওয়া খানা ক্যাম্প, কাটাখালী ব্রীজের অপর প্রান্তের সড়ক ও জনপদ বিভাগের একটি ভবন যুদ্বকালীন সম্পূর্ন সময় ধরে নির্যাতনের একটি বিভীষিকাময় অধ্যায়ের অংশ সম্প্রতি করতোয়া নদীর গর্ভে বিলিন হয়ে গেলেও নির্যাতিতদের স্মৃতিতে এখনো জেগে আছে ভবনটি। এখানে নদীর চরে অসখ্য মানুষকে হত্যার পর মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে ।
বর্তমানে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ও সাংসদ এখানে গণকবরের সম্মানে একটি সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়েছে। পরবতীতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহীদদের উদ্দেশ্যে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয় ।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১১ ডিসেম্বর ভোর রাতে হিলি গাইবান্ধা ও বোনারপাড়া এবং মহিমাগঞ্জ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সমুখে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধে হয়। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১১ ডিসেম্বর বিকেলে গাইবান্ধা থেকে নাকাইহাট, বোনারপাড়া থেকে মহিমাগঞ্জ এবং হিলি থেকে আসা মিত্র বাহিনীর ত্রিমুখি আক্রমণে প্রায় ২০০ পাক সেনা নিহত হয়। অন্যরা ইউনিফর্ম খুলে লুঙ্গি, গেঞ্জি পড়ে সাধারণ মানুষের বেশে পালিয়ে যায়।
পরদিন ১২ ডিসেম্বর সকালে জয়বাংলা শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে সমবেত হয়ে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

আপনার মতামত লিখুন :