সাঁওতালদের রক্তভেজা তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণ বন্ধের দাবি
কলঙ্কের দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে; সুলতানা কামাল
গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনধি;
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘বিগত পাঁচ বছরেও তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার হয়নি। একটি জাতি যখন সেই দেশে ঘটানো অন্যায় ও অপরাধের বিচার করে না, সেই কলঙ্ক কিন্তু জাতির গায়েও লাগে। আমরা এদেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে তা মেনে নিতে পারি না। আমরা এই কলঙ্ক বহন করতে রাজি নই। রাষ্ট্র যদি এখানে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে, বিচার না করে, সেই কলঙ্কের দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আমরা বারবার এই হত্যার বিচার দাবি করব।
শনিবার দুপুরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটামোড় এলাকায় সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির আয়োজনে সাঁওতাল হত্যা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত শোক র্যালি ও সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী ইউনিয়ন, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি), কাপেং ফাউন্ডেশন, সিডিএ এবং জনউদ্যোগ- এর সহযোগিতায় এই শোক র্যালি ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে সুলতানা কামাল বলেন, ‘সরকারের অনেক জায়গা থাকতে, বাগদাফার্মেই কেন ইপিজেড করতে হবে? এখানে ইপিজেড নির্মাণ চলবে না। আমাদের রাষ্ট্রনীতিতে রয়েছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার উল্লেখ করছেন তিন ফসলি জমিতে কোন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে না। কারণ বাংলাদেশে অনেক খাস ও পতিত জমি রয়েছে। যেখানে শিল্প কারখানা করা যায়। শিল্প কারখানা হলে উন্নয়ন হবে, কর্মসংস্থান হবে। সব ঠিক আছে, কিন্তু সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জমির দিকে সরকারের নজর পড়ে কেন? তাদের জীবিকা যেখান থেকে আসে, যেখানে তারা উৎপাদন করেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে কারণ আছে। সরকার কখনো কোনো জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করতে পারে না।’
‘সেই জায়গায় আমাদের জোর দিয়ে কথা বলতে হবে। তাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। আমরা নানাভাবে এই বার্তা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আন্দোলনের মাধ্যমে এখানে ইপিজেড নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য করব।’
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কের সভাপতিত্বে ও নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগের সদস্যসচিব প্রবীর চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, এএলআরডির প্রধান নির্বাহী শামসুল হুদা, জেলা জাসদ সভাপতি গোলাম মারুফ,,নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বাবু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক আগারওয়াল, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রচার সম্পাদক সুভাষ হেমব্রম, সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব জাহাঙ্গীর কবীর, আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদের উপজেলা শাখার আহবায়ক গোলাম রব্বানী মুসা, মানবাধিকার কর্ অঞ্জলী রানী দেবী, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সবিন মুন্ডা, মানবাধিকারকর্মী অঞ্জলী রানী দেবী, সুজন প্রসাদ, সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপন শেখ, সুফল হেমব্রম, প্রিসিলা মুর্মু ও অলিভিয়া হেমব্রম প্রমুখ।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের জমিতে ইপিজেড নির্মাণ বন্ধসহ সাত দফা দাবি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে বক্তারা বলেন, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জস্থ রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনসহ স্থানীয় প্রভাবশালী সন্ত্রাসীদের দ্বারা সাঁওতালদের নির্মিত বসতবাড়িতে উচ্ছেদের নামে নিরীহ সাঁওতালদের ওপর হামলা, বসতবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং বর্বরোচিতভাবে গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নিহত এবং অনেকেই গুরুতর আহত হন।
‘ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার করতে হবে। কেননা ইতিমধ্যে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। আমাদের বাপ-দাদার জমি আমাদের ফেরত দিতে হবে। সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে লুটপাটের ক্ষতিপূরণ এবং সাঁওতালদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি জানান বক্তারা।’
এর আগে সকালে সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম থেকে তির-ধনুক, ব্যানারসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সংবলিত ফেস্টুন নিয়ে একটি শোক র্যালি বের হয়।
মিছিলটি গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের কাটামোড়ে গিয়ে শেষ হয়।

