মহেশখালীতে উন্নয়নের নামে পরিবেশসহ জীবন-জীবিকার ক্ষতি
মোহাম্মদ শাহাব উদ্দীন, মহেশখালী;
মহেশখালী উপজেলাকে একটি বিদ্যুৎ ও উন্নয়ন হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সেই লক্ষে বেশ কয়েকটি কয়লা ও এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য ফিজিক্যাল কাজ শুরু হয়েছে। এ কারণে নানাভাবে ক্ষতির কবলে পড়েছে ওই এলাকায় বসবাসরত মানুষ, হুমকীতে পড়েছে পরিবেশও। সেখানে সংশ্লিষ্ট আইন ও আইনের প্রয়োগে নানারকম ব্যত্যয় ঘটছে। লংঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। প্রকল্পের কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুকি এবং ক্ষতিগ্রস্ত, জেলে সম্প্রদায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন সহ জীবন-জীবিকা হুমকীর মুখে পড়েছে। বেড়েছে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের দূর্ভোগ। স্থানীয় মানুষ এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললেও কার্যত কোন সফল পাচ্ছেন না। মহেশখালীতে সরকারীভাবে ও কোম্পানী মিলে ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছে এমন তথ্য পাওয়া গেলেও বাস্তবে তার এখনো এত প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। যদি সকল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় তাহলে মহেশখালীর মানুষ ও পরিবেশ চরম ঝুকিতে পড়বে।
মহেশখালীতে যে সকল উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে;
১, মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেঘাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল কোল ফায়াড পাওয়ার প্লান্ট নিমাণের জন্য ১৪১৪ একর, ২) ৭০০ মেগাওয়াটের কোহলীয়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১১৯৮ একর, ৩) মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় সড়ক, সেতু ও এপ্রোচ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে ৬২.২৫৭ একর, ৪) এল.এন.জি ও কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৪৯৬১.৯৫ একর, ৫) মহেশখালী- আনোয়ারা ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৯১ কিঃ মিঃ গ্যাসের সঞ্চালন লাইন প্রকল্পে, ৬) মহেশখালী- আনোয়ারা ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের ৭৯ কিঃ মিঃ গ্যাসের সঞ্চালন সমান্তরাল পাইপ লাইন ও আনুসাঙ্গিক ফ্যাসিলিটিস নির্মাণ প্রকল্পে ২৬.৫৬ একর,৭) মহেশখালী জিরো পয়েন্ট হতে মহেশখালীর সিটিএমএস পর্যন্ত ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের ৭ কিঃ মিঃ গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন প্রকল্প, ৮) ইন্টেলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন স্থাপন প্রকল্পে (এসপিএম) ৩২.৪০ একর,৯) এলএনজি টার্মিনাল-১ (সোনাদিয়া) ৫০০ একর, ১০) এলএনজি টার্মিনাল-২ সোনাদিয়া ৭০০ একর, ১১) সোনাদিয়া ইকো টুরিজম পার্ক (বেজা) ৮০৪৫.৭৭ একর, ১২) মহেশখালী অথনৈতিক জোন-৩ (ধলঘাটা) ৩০৫৫.৪৬ একর, ১৩) কোললীয় অথনৈতিক অঞ্চল (ধলঘাটা) ১০০০ একর, ১৪) মহেশখালী অথনৈতিক অঞ্চল ( বেজা)১১৪৭১.২৭ একর, ১৫) মহেশখালী অথনৈতিক অঞ্চল-১ (প্রস্তাবিত) ৮২৬ একর, ১৬) মহেশখালী অথনৈতিক অঞ্চল-২ (প্রস্তাবিত) ৬৭০ একর, ১৭) ডিডিটাল আইল্যাল্ড মহেশখালী। এছাড়াও মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের অধিগ্রহণকৃত জমিতে ১২০০ মেগাওয়ার্ডের একং কোহলীয় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৭০০ মেঘাওয়ার্ডের আরও একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পেজ-২ তে করার পরিকল্পনা রয়েছে।
মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিচিতি;
মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় আমদানীকৃত কয়লা লোড-আনলোড জেটি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, টাউনশীপ নির্মাণ, স্থানীয় এলাকায় বিদ্যুতায়ন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। উক্ত প্রকল্পের পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন/সমীক্ষা (ঊওঝঅ) এবং সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ঋবধংরনরষরঃু ঝঃঁফু) ২০১৩-১৪ অর্থ-বছরে সম্পাদন করা হয়েছে বলে কোল পাওয়ার দাবী করছে। এ লক্ষে বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার মধ্যে ১৬ জুন ২০১৪ ইং তারিখে একটি ঋণচুক্তি সম্পাদিত হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৫,৯৮৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট অর্থায়নের ২৮,৯৩৯ কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য হিসেবে জাইকা থেকে এবং অবশিষ্ট ৭০৪৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সিপিজিসিবিএল এর নিজস্ব তহবিল থেকে সংস্থান করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ দক্ষ জনবল তৈরি করা।
জাইকা-এর অর্থায়নে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানী বাংলাদেশ লি. কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ১২০০ মেঃ ওঃ কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পনির্মাণের নিমিত্তে মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী মৌজায় অধিগ্রহণকৃত ১৪১৪.০৫ একর ভূমি গত ১৪/০৮/২০১৪ তারিখ প্রত্যাশী সংস্থাকে দখল হস্তান্তর করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮০% ভূমির মালিকদের মধ্যে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করা হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পেন্টা-ওশান কর্তৃক প্রাথমিক পর্যায়ের নির্মাণ কাজসমূহ (ঞবসঢ়ড়ৎধৎু পযধহহবষ, বাঁধ, ল্যান্ডিং জেটি, অফিস বিল্ডিং) ৯০% সম্পন্ন হয়েছে বলে কোল পাওয়ার দাবী করেছে।
প্রকল্পের কারণে ক্ষতি;
জলবদ্ধতাঃ
কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে জলাবদ্ধতাসহ নানা সমস্যা। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাটি ভরাটের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন মাতারবাড়ীর হাজার হাজার মানুষ। জাইকার অর্থায়নে ১,২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে ৮টি স্লুইসগেট ও প্রাকৃতিক পানি নিস্কাশনের সবগুলো পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রতি বছর এলাকার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। এছাড়াও পানি নিস্কাশণের একমাত্র খাল রাজাখালী নামক খালের মুখ বন্ধ রয়েছে। যার দরুন বিগত চার বছর ধরে মাতারবাড়ীর জনসাধারণের বছরের ৩/৪ মাস জনদূর্ভোগে পড়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলো। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারেনা কোমলমতি শিশু-কিশোররা। ব্যাহত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া। রাস্তাঘাটও পানির নিচে থাকে, বাড়িঘরে পানি উঠে যায়। ফলে স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, পানি বাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। জলাবদ্ধতার কারণে ৩ বছরে ৪ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, ছাত্রছাত্রীদের বহনকারী নৌকাডুবির ঘটনাও ঘটেছে। ওই সময় শতাধিক পরিবার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করতে বাধ্য হয়। স্বাস্থ্য ঝুকিঁ, স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়। এমনকি ওই সময় বেশকিছু বাড়ীতে রান্নার খাবারও তৈরী করতে পারে না জলবদ্ধতার কারণে। প্রকল্প ব্যতিত সামান্য যে জমিগুলি চিংড়ী, ধান ও লবন চাষ করা যায় তাও ব্যাহত হচ্ছে।
সরেজমিন সাধারণ মানুষের অবস্থা দেখতে জাপানের টোকিও থেকে জাইকার পরিচালক (বাংলাদেশ) তাকাশিয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর মাতারবাড়ী পরিদর্শন করেন। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, মাতারবাড়ীর মানুষের ক্ষতি হয় এমন কাজ তারা করবে না। বাঁধের কারণে প্রকল্পের আশপাশের জনগোষ্ঠী পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এবং তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমরা এই অভিযোগ সরেজমিন দেখতে, চেয়ারম্যান ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। আপনারা এ ব্যাপারে যা বলবেন তা গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের কথা গুরুত্বসহকারে শোনা হলেও তাদের আশারবাণীর বাস্তবে কোন মিল খুজে পায়নি মাতারবাড়ীর মানুষ।
কোললীয় নদী ভরাট ও দখল;
পাশেই কোহেলিয়া নদী। নির্মাণকাজসহ অন্যান্য কাজের নানা রকম কঠিন বর্জ্য এই নদীতে ফেলা হচ্ছে। জমি উঁচু করার পর উদ্বৃত্ত মাটি আর বালু নদীতে যাচ্ছে। নদী নাব্যতা হারাচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে প্রকল্পে সাগর থেকে বালি মাটি ভরাট করার ফলে এ বালির অংশ বিশেষ ও প্রকল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন বর্জ্য কোহেলিয়া নদীতে পড়ায় বর্তমানে গভীর এ নদী একেবারে ভরাট হয়ে গেছে। যার কারণে পূর্ণ জোয়ার ছাড়া এ নদীতে কোনো ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারেনা। আবার জোয়ার হলেও গভীরতা কমে যাওয়ায় মাতারবাড়ী কোহেলিয়া নদীর উপর স্থাপিত ব্রিজের কারণে সকল ধরনের নৌযান এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে না পারায় এখানকার লবণ ব্যবসায়ী, ট্রলার মালিক ও নৌযানের মাঝি-মাল্লাদের কপালে পড়েছে হাত। পাশাপাশি হাজারও মৎস্য চাষী যারা কোহলীয় নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত তারাও বেকার হয়ে পড়েছে। কোহেলিয়া নদীর কারণে আনুমানিক ৫ হাজার জন জেলে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৫০০ জন।
অন্যান্য পেশার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। পশ্চিম দিকের বেড়িবাধের ভাঙ্গনের কারণে ৪৫ টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং
১২ টি পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে।
চাকরী,কর্মসংস্থান ও পেশাহারা;
বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় আনুমানিক ৭৪০ এর মত এলাকার শ্রমিক কাজ করছে। এর মধ্যে মাসিকভিত্তিতে ২৩০ জনের মত ও দৈনিকভিত্তিতে প্রায় ৫১০ জন। এর বাইরে বর্তমানে প্রায় ১০/১৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এছাড়াও কর্মরত শ্রমিকরা শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেনা। প্রাপ্ত বেতন হতেও দালালরা প্রতি শ্রমিকের কাছ থেকে কমিশনের টাকা কেটে করছে কমিশন বাণিজ্য। অথচ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চাকুরী দেওয়ার কথা ছিল। তারপরও তারা ক্রমে শ্রমিক ছাটাই করে করেছে। সম্প্রতি ২৬৪ জন শ্রমিককে চাকরীচ্যুত করে জেলার বাহির থেকে প্রয়োজন অনুসারে শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। হোন্ডাই কোম্পানীতে কর্মরত একজন শ্রমিক মো. ইউনুছ এর তথ্যমতে, এ বছরের নভেম্বরেম দৈনিক ভিত্তিতে কর্মরত মাতারবাড়ীর ১৫০ জন শ্রমিককে হোন্ডাই কোম্পানী থেকে চাকরীচ্যুত করা হয়েছে। মাতারবাড়ী ও ধলঘাট মিলিয়ে প্রকল্পের কারণে বেকার হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ২০০০০ হাজার এর বেশি। বেকার হওয়া মানুষের জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেনি।
ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী একটি লিখিত দাবিনামা জাইকা প্রতিনিধিদলের হাতে তুলে দেন। এতে বলা হয়, দুটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করার জন্য প্রায় ৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যে জমি ছিল মাতারবাড়ীর মানুষের জীবন-জীবিকার মূল উৎস। লবণ ও চিংড়ি চাষের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মানুষ আজ কাজ হারিয়ে অসহায় বেকার জীবন-যাপন করছে। যে সামান্য জমিতে চাষাবাদ করা যেত, তাও আজ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে পানির নিচে। জমি অধিগ্রহণের আগে স্থানীয়দের বলা হয়েছিল, জমির ন্যায্যমূল্য দেওয়া হবে, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি মানুষকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, পুনর্বাসন করা হবে, মাতারবাড়ীতে কেউ বেকার থাকবেনা, সবাইকে প্রকল্পে কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া। কিন্তু স্থানীয় শ্রমিকের পরিবর্তে বাইরে থেকে হাজার হাজার শ্রমিক এনে সেখানে কাজ করানো হচ্ছে। অথচ মাতারবাড়ীর হাজার হাজার মানুষ আজ বেকার। অর্থাভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে তারা।
উচ্ছেদকৃত পরিবার;
প্রকল্পের কারণে ২০১৪ সালে উচ্ছেদ হওয়া ৪৫টি পরিবার বিগত ৫ বছর ধরে মানবেতর জীবন-যাপনের পর অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর ৩৯টি পরিবার পূণবাসিত হলেও এখনো ৬টি পরিবার পূণবাসিত হয়নি। ওই সময় থেকে তারা নি¤œ মানের বাড়ীতে বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে বসবাস করেছে। তাদরে পরিবারের সদস্যদের দৈনিক মজুরীতে কিছু কাজ দেওয়া হলেও স্থানীয় কোন চাকরী দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি এখনো তাদের উচ্ছেৎ হওয়া বাড়ীর ক্ষতিপূরণ। গত ৫ বছর ধরে উচ্ছেৎকৃত পূণবাসিত না হওয়া ৬ পরিবার হচ্ছে আবদুল জাব্বার, মুফিজুর রহমান, মোহাম্মদ কাইছার, মোহাম্মদ ইউনুছ, বদর উদ্দীন ও মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন এর পরিবার।
ক্ষতিপূরণ;
অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণের (একর প্রতি ৯-১৩ লাখ টাকা) দেওয়া এখনও শেষ হয়নি, বর্ধিত (একরপ্রতি ২৭-৩০ লাখ টাকা) পেয়েছেন মাত্র ৫% ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। পেশাহারা শ্রমিক ও অন্য পেশাজীবীদের ২১ ক্যাটাগরিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।
অধিগ্রহণকৃত জমির কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও এখনো অধিকাংশ জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পাইনি। এমনকি ভুয়া , কাগজ সৃজন করে এলও অফিস থেকে একজন অন্যজনের টাকা উত্তোলন করেছে। ফলে মূল ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে এখনও টাকা পাননি। আবার অনেকেই এর বিরুদ্ধে মিস মামলা করলেও তা হাতিয়ে দেখছেনা কর্তৃপক্ষ। আজ কাল করে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। কেন ক্ষতিপূরণ দেয় হচ্ছে না তা ক্ষতিগ্রস্তদের স্পষ্ট করে জানানো হচ্ছে না। কতজন ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়েছে এবং কতজন পাননি এবং কি কারণে পাচ্ছেন না তার একটি তালিকা প্রকাশ না করায় সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। হয়রানি ছাড়া দ্রুত সকল প্রকার মামলা ও অংশিদারিত্ব ঝামেলা নিষ্পত্তি করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করার জন্য ক্ষতিগ্রস্তরা দাবী জানালেও তা বাস্তবায়ন দৃশ্যমান না। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঘোষনা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক জমির অংশিদার প্রত্যেক মালিককে এনজিও সুশিলন এ মাধ্যমে ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিলেও বতর্মানে তা দিচ্ছেনা। মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক ২৩৩৫ জন। এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছ ১৯৮৭ জন। ৫৬ জন ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান, ৯০৮ জন শ্রমিককে এককালিন অনুদান, ২৫৬ জন বর্গাচাষী ভাগীদার ও লীজ গ্রহীতাদের এককালিন অনুদান, ৬ জন গাছ মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। ২১৫৬ জনকে ১ লক্ষ ২০ হাজার করে দেয়ার কথা ছিল। যার মধ্যে প্রায় ১৬০০ জন টাকা পেয়েছেন। তবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে জেলা প্রশাসন। গত ১৫ ডিসেম্বর মাতারবাড়ীতে গিয়ে সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক ১২৩ জন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ২ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা বিতরণ করেন।
চালিয়াতলি টু মাতারবাড়ী সড়কের বর্তমান অবস্থা;
মাতারবাড়ীর সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য নির্মিত সর সড়কটি দিয়ে বর্তমানে প্রকল্পের ভারি মালামাল বহন করে প্রতিদিন হাজারও ট্রাক, লরি, ডাম্পার গাড়ী চলাচল করছে। ফলে সড়কের অবস্তা খুবই খারাপ, দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুর ১টায় সড়ক দূর্ঘটনায় মাতারবাড়ী মাইজপাড়া গ্রামের প্রবাসী মোহাম্মদ হোছাইনের একমাত্র শিশু সন্তান মোহাম্মদ ওয়াকিফ (৩) গাড়ীর ধাক্কায় নির্মম মৃত্যু হয়। ১৯ মার্চ ভয়াবহ সড়ক দূর্ঘটনায় ফুলজান মুরা গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে শেফায়েত উদ্দীন (২৭), মাঝের ডেইল এলাকার নাছির মোহাম্মদের ছেলে মামুন নিহত হয়। আহত হয় আরও ৬ জন। এ ঘটনার জের ধরে কয়েকবার নিরাপদ সড়কের দাবীতে মাতারবাড়ী সিএনজি স্টেশনে বিশাল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিতসহ প্রধান সড়কেও গাড়ী চলাচল বন্ধ করে দেয় জনগণ। ইতিপূর্বে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় বেশ কজনের। ছোট্ট গ্রামের রাস্তায় অতিরিক্ত গাড়ী চলাচলের কারনে দূর্ঘটনাসহ এলাকায় বায়ু দূষণ, যানজট ও শব্দ দূষনের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।
স্থানীয় একাধিক শ্রমিক জাননা, প্রকল্পে যারা চাকরী করে তারা নিজেরাই ঠিকাদারী করার কারণে তাদের নিজের এলাকা থেকে লোক নিয়ে এসে কাজ দিচ্ছে ফলে স্থানীয়রা চাকুরী পাচ্ছে না বলে জানান।
মহেশখালী জনসুরক্ষা কমিঠির সভাপতি নুর মোহাম্মদ বলেন, সরকার উন্নয়ন প্রকল্প নির্মাণের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সাবির্ক সহযোগীতা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও প্রকল্প এলাকায় যারা দায়িত্বে রয়েছে তাদের অবহেলা ও অনিয়মের কারণে মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতির ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয়দের চাকরী না দেওয়া, ক্ষতিপূরণ যথা সময়ে না দেওয়া, জলবদ্ধতা, বেড়িবাধেঁর পাশ থেকে ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন করার কারণে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তা দ্রুত সমাধান করা জরুরী।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, সম্প্রতি মাতারবাড়ীর কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ফলে পানি নিস্কাশনের স্লুইসগেট সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিস্কাশনের অন্য পথগুলোও। এতে তিন বছর ধরে বৃষ্টির পানি বের হতে পারছেনা। ফলে মৌসমি বৃষ্টির পানিতেও মাতাবাড়ীতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ। তিনি আরও বলেন, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে ক্ষতিপূরণ, চাকরীসহ মাতারবাড়ীর মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
মহেশখালীর কৃতি সন্তান বুদ্ধিজীবি ও গবেষক ড. সলিমুল্লাহ খানেঁর মতে,বর্তমান সরকার পরিকল্পনা করছে কক্সবাজারের ৫০ মাইল ব্যাসাধের মধ্যে ১৭টি কয়ালা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের পরিকল্পনা করছে। সে গুলো করলে জীবন থাকবে না বলে মন্তব্য করে বলেন, ৩০ বছরে একটি মানুষও থাকতে পারবে না। মহেশখালী বিরান ভূমিতে পরিনত হবে। মহেশখালী কি দোষ করলো, কি কারণে একটি দ্বীপে ১৫টি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হবে? মহেশখালীতে কোন রাজনৈতিক শৃংখলা নেই বলে মহেশখালীতে এত বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার পরিকল্পনা করছে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র জার্মাণী, অস্ট্রেলিয়াতে যেখানে একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়। সেখানে ৫০ মাইল ব্যাসাধের মধ্যে কোন মানুষ থাকতে পারে না।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। তার দপ্তরের কর্মকর্তারা আন্তরিকতার সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের সার্বিক সহযোগীতা করছে বলে জানান। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর গোলাম কিবরিয়ার সাথে যোগাযোগ করার পরও ফোনে সংযোগ না পাওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, সরকার জনগণেরর উন্নয়নের জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে। উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মহেশখালী হবে সিঙ্গাপুর। কাজরে সন্ধানে বিদেশ যেতে হবে না। বরং মহেশখালীতে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। যদি প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও স্থানীয়দের সাথে আলোচনা করে সমস্যা চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধান হবে। জমির মালিক ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকায় কেউ ঘুষ দাবী করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া হবে।

