আদিবাসী তথ্য- কারাম উৎসব বা ডাল উৎসব
মির্জা মোঃ আজিম হায়দার, উন্নয়ন কর্মী;
এই উৎসবগুলো সম্পর্কে জনগোষ্ঠীর বয়স্কদের সাথে কথা বলে লেখা। এগুলোর বিষয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে তবে বেশীরভাগ মানুষের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে লেখা। যারা আদিবাসীদের সম্পর্কে জানতে চান তারা এগুলোকে পড়তে পারেন এবং অন্যদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বর্তমান যুগের ছেলে-মেয়েদের ধারণা একেবারেই নগন্য। কারণ তারা বর্তমান অবস্থায় যা দেখছে সেটা নিয়েই বেশী ভাবে। আর এই উৎসবগুলো একসময় অনেক বেশী জনপ্রিয় ছিল। নিম্নে উৎসব সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
কারাম বা ডাল উৎসবঃ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে কারাম। আদিকাল থেকে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের ধারায় সহজ-সরল ভাবে জীবন যাপন করে আসছে জনগোষ্ঠী। অনন্তকাল বিলীন হয়ে চলেছে সত্য কিন্তু তাদের শব্দ, নৃত্যগীত, সামাজিক উৎসবাদি, চরিত্র, ভাষা বাঁচা-বাড়ার প্রযুক্তি, অনন্ত কালের তথ্য ও তত্ত্ব বহন করে আসছে যা গবেষণা করলে তাদের চলমান জীবনে নির্দেশনার একমাত্র গ্রন্থ হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। জনগোষ্ঠীগুলোর প্রাণ-প্রিয় উৎসব কারাম বা ডাল পূজা। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের চাঁদের একাদশী তিথীতে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। আবার অনেকেই ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিনে এই উৎসবের আয়োজন করে। কেহ কেহ দুর্গোঃসবের দশমীর দিনও দাশ কারাম অনুষ্ঠান করে থাকে। এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উক্ত তিথীগুলোর পূর্ব থেকে মাসাধিক কাল প্রভূতি চলে। আদিবাসী নর-নারী আবাল-বৃদ্ধ বনিতা সকলে প্রতিটি রাত নৃত্য-গীত ও বাদ্য-যন্ত্রে মুখরিত করে রাখে এবং সকাল হলেই নিয়মিত ভাবে কাজে চলে যায়। এ কারাম পূজা তাদের জীবন ধারায় কেবল অনাবিল আনন্দই বয়ে আনে না বরং ধর্মেরই প্রতীক হিসাবে তাদের জীবনে থাকে।
কারাম পূঁজার জন্য কারাম গাছের ডাল কাটার জন্য প্রথমে পূঁজা দিতে হয়। এই ডাল কাটার পুঁজার জন্য যা যা লাগে তা হচ্ছে- লাল গামছা, সুতা, তেল, সিদুর, কলা, পান-সুপারি, ধুপ, দূর্বাঘাস, আতব চাল, তেল পিঠা ইত্যাদি দিয়ে পূঁজা দিতে গাছের গোড়ায় পুঁজা করা হয়। যারা ডাল কাটবে তারা উপবাস করবে একজন ডাল কেটে অন্য জনের হাতে দিবে সে আর একজনের কাছে দিবে। ডাল কাটার সময় এক কোপে কাটতে হবে। ৩টি ডাল কাটতে হবে। এই সময় গান করা হয়। ডাল কাটার পর সাধারণত প্রধানের বাড়ীতে রাখা হয়। প্রধান একক ভাবে এই পূজা আয়োজন করতে পারে আবার দশজনে মিলে করতে পারে। যেখানে পুঁজা আয়োজন করা হবে সেখানেই সকলের পছন্দ্র মত ডাল রাখা হবে। একক ভাবে হলে নিজের পছন্দ্র মত স্থানে ডাল রাখা হয়।
কারাম পূজার কাহিনীঃ ধর্মের প্রতীক কারাম গাছের ডাল তাই এই কারাম ডালই এই পুজার কেন্দ্র বিন্দু হিসাবে থাকে। বড় ভাই কারমা হচ্ছে কর্মের প্রতীক। আর ছোট ভাই ধারমা হচ্ছে ধর্মের প্রতীক। কথিত আছে আদিকালে কারমা ও ধারমা দুই ভাই ছিল। কারমা বড় ধারমা ছোট। কারমা ব্যবসা-বাণিজ্য করে অনেক টাকা পয়সা ও জমি-জমার মালিক হয়। ধনে অহংকার জনগোষ্ঠীর অপ্রিয় হিসাবে ছিল সমাজে। ছোট ভাইকে ঘৃণা করত বড় ভাই কারমা। ধর্ম্মের দিকে মন ছিল না। অপর দিকে ছোট ভাই ধারমা জনগোষ্ঠীর প্রিয় ছিল। মনে কোন অহংকার ছিল না ধর্ম্মকে বড় মনে করত এবং ধর্ম কাজেই সে নিজেকে ব্যস্ত রাখত। সময়ের ব্যবধানে অহংকারী বড় ভাই কারমা গরীব হয়ে গেল। জমি জমা বলতে বাড়ীঘর ছাড়া তার আর কিছু ছিল না। অন্যের জমিবর্গা চাষ করে অতীব কষ্টে জীবন যাপন করতে আরম্ভ করে তবু তার মনের অহংকারে ধর্মকে ঘৃণা করতো।
অপরদিকে ধার্মিক ধারমা অনেক জমি-জমার মালিক হয়ে গেল। উত্তরোত্তর জনশক্তি বেড়ে গেল একবার বর্ষার সময় এলাকার সকলেই জমি রোপনের কাজ শেষ করে ফেলে। ধারমার অনেক জমি হেতু শেষ করতে পারে নাই। ধারমা দিন তারিখ ঠিক করে এলাকার সকলকে আমন্ত্রণ করে। অল্প সময়েই জমিতে চারা লাগানোর কাজ শেষ হয়ে গেছে। বড় ভাই ও ভাবী দুজনে জমিতে গিয়ে চারা লাগায়। শেষে সকলেই খাওয়া দাওয়া করে নিজ নিজ বাড়ী চলে যায়। কারমা ঝগড়া করার জন্য খাওয়ার সময় ডাকে নাই। কারমার নিজ বাড়ীতেও ঐ দিনে কোন খাবার ছিল না। দুজনে না খেয়ে শুয়ে থাকে। গভীর রাত্রে স্ত্রীকে নিয়ে মাঠে যায় এবং তাদের লাগানো চারাগুলো অন্যের জমিতে উঠায়ে ফেলে দেয় সত্য কিন্তু চারাগুলো পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে। তার স্ত্রী বলে দেখ ধর্মের জয়। কারমা নিজের স্ত্রীকে ও গালা-গালি দেয়।
উক্ত ঘটনার এক বৎসর পর ভাদ্র মাসের চাঁদের একাদশীতে কারাম পূজার দিন। গ্রামের সবাই কারাম উৎসবে বিভোর। কারমা অন্যের জমি বর্গা করে। ভোরে জমি চাষ করতে চলে যায়। দুপুর অবধি রাস্তায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে তার স্ত্রী খাবার নিয়ে আসেনি। রাগে অতিষ্ট হয়ে বাড়ী যায়। তার স্ত্রী ও নৃত্য গীতে আত্মহারা হয়ে আছে। কারমা তার স্ত্রী বাড়ীতে খাবার ঘরে প্রবেশ করে খেতে চায় কিন্তু পোকায় পরিনত হয়। কোন কিছু খেতে পারে না। অবশেষে কারাম ডালটি খুজে এনে পূজায় রত হয়। পরিনামে হারানো ধন-সম্পত্তি ফিরে আসে। দুভাই পরবর্তীতে রাজার মত বসবাস করতে থাকে। কারমা স্বীকার করে ধর্ম্মই বড়। যে ধর্ম্মকে রক্ষা করে তাকে ধর্ম্মও ধর্ম রক্ষা করে। ধর্ম্ম না করলে কর্ম নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য বলে কারমা-ধারর্মা দুই ভাই।
কারাম পুজা কিভাবে করা হয়ঃ প্রতি বৎসর ভাদ্র-মাসের চাঁন্দের শুরু পক্ষের একাদশী তিথিতে কারাম পুজার নির্দিষ্ট দিন তারিখ। এ তিথির এক সপ্তাহ পূর্ব থেকে পূজার উপকরণাদি সংগ্রহের জন্য প্রস্ততি চলে। গ্রামের কুমারী মেয়েরা ও যুবক ছেলেরাই পূজার দিন উপবাস থাকে। যে কারাম পূজা করে সে পঞ্চশস্য (গম, যব, সরিষা, কলাই, তিল) সংগ্রহ করে তিনজন কুমারী বাছাই করে তিনটি বাঁশ বা বেতের তৈরী নতুন ডালায় মাটি বালি দিয়ে পূর্ণ করে। সংগ্রহ করা শস্যাদি তিন জনের ডালায় ভাগ করে দেয়। তিন জন কুমারী মেয়ে কয়েক দিন ধরে নিজ নিজ ডালায় পরিচর্যা করে। পুরোহিতের নির্দেশ যারা সৎ এ সর্বদা যুক্ত থাকবে, মিথ্যা কথা বলবে না, পবিত্রতা রক্ষা করবে, সদালাপি হবে, কুচিন্তা করবে না তাদের চারাগুলো সতেজ ও সবল হবে। ব্যতিক্রমে চারাগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়বে এবং অনেক চারা নষ্টহয়ে যাবে। পূজার দিনে সূর্য্য অস্ত যাওয়ার মুহুর্তে বন থেকে কারাম গাছের তিনটি ডাল সংগ্রহ করার জন্য বাদ্য যন্ত্রসহ দলবদ্ধ ভাবে নারী পুরুষ যায় এবং নৃত্য গীত করতে করতে ডাল নিয়ে আসে। তিনটি ডাল বিশেষ নিয়মে একটি গর্তে পুতে রেখে পূজা অর্চনা করে। তিনটি চারার ডালাসহ উপবাসী ছেলে মেয়েরা বৃত্তকারে বসে। বিশেষ ভাবে দক্ষ যে ব্যক্তি কিচ্ছা কাহিনী সবাইকে শুনায়। ছেলে মেয়েরা পুষ্পাদি নিবেদন করে এবং কারাম গাছের ডালটি সবাই ধরে। পুরোহিত বলে কারাম ডাল ধরে তোমরা কি পেলে? সকলেই বলে কদুর মত ছেলে পেলাম। ধন জন পাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। উপদেশ দেওয়া হয় ধারমার মতন ধর্ম্ম অর্থাৎ কারাম পূজা করলে সংসারে উন্নতি হবে আর কারামপূজা না করলে কারমার মত গরীব হয়ে পড়বে। তারপর তারা সারা রাত ধরে নৃত্যগীত। অফুরন্ত গানে ভরপুর গানগুলো ধর্মীয় চর্চার ইঙ্গিত রয়েছে তাড়ি হাড়ি মদও এ অনুষ্ঠানের প্রধান উপকরণ। বাড়ী বাড়ী চালের আটা দিয়ে মিষ্টান্ন তৈয়ারী করে। তিনটি কাঠাল পাতায় তৈয়ারী মিষ্টান্ন, আদি পুরুষ কে নিবেদন না করা অবধি এক জন শিশু ও তা মুখে দেয় না। প্রথম গানে কারাম ডালটিকে সবাই বন্দনা বা ভক্তি করে।
এ কারাম পূজায় বনের মধ্যে অনেক গাছপালা থাকাসত্ত্বেও কেবল মাত্র কারাম গাছের ডালটি সংগ্রহ করে। অনেকে এ গাছটিকে তেল কদম বলে। এ গাছের ডালটিকে নিয়ে খেলাকরে জন্য কেহ কেহ খেল কদমও বলে থাকে। কথিত আছে যে শ্রীকৃষ্ণও কদম গাছের ডালে বসে বাঁশী বাজাইত। কীর্তনে গান গায় কৃষ্ণের বাঁশীতে যমুনার স্রোত উজান মুখে বায়। শ্রীকৃষ্ণের আদি পুরুষ বা প্রেমের গুরু রাধা। কারাম পুজার কাহিনিতে বলা হয় লতা-পাতা-স্রোতে টানে দ্রুত বেগে সমুদ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আর উঠায়ে ফেলে দেওয়া কারাম ডালটি মাঝ-সমুদ্র থেকে উজান মুখে ছুটে আসছে। সমুদ্রের কুলে এসে হাজির হয়। কারমা দেখে অসংখ্য কুমীর জলজন্ত ডালের চারি পার্শ্বে মাতোয়ারা হয়ে আছে। কারমা জীবনের আশা ত্যাগ করে ঝাপিয়ে পড়ে এবং কারাম ডালটি স্পর্শ করে। তৎক্ষনাৎ কুমির ও জলজন্ত অদৃশ্য হয়ে গেল। অসীম শক্তির অধীকারী হয়ে ডালটি তুলে নিয়ে নৃত্যগীত করে।
অর্থাৎ এ অনাহত নাদে বনে গাভীগুলো চমকে বেড়াচ্ছে ঘুমন্ত বাঘ ও জেগে উঠেছে প্রসঙ্গতঃ তাড়ি, হাড়ি, মদ, মিষ্টান্ন পূজার উপকরণনাদি এক মাত্র আদিপুরুষকে নিবেদন করে। এখানে প্রশ্ন উঠে কে সে আদিমপুরুষ? শ্রী কৃষ্ণের আর্বিভাব এর পূর্বে থেকে অর্থাৎ রামচন্দ্রের সময় থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায় দুর্গোৎসবে বাড়ী বাড়ী নৃত্য-গীত করে এই উৎসব পালন করা হয়। কারাম উৎসব পালনের সঙ্গে উঁরাওদের একটি কাহিনী জড়িত আছে। তাদের মতে, কারাম বৃক্ষ রক্ষাকর্তার মত। ইতিহাসের কোনো এক সময় উঁরাও জাতি অন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সময় গভীর জংগলে পালিয়ে কারাম গাছের নীচে আশ্রয় নিয়েছিল। কারাম বৃক্ষ যেন তাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছিল। এই ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য কারাম উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থকে।
এই উপলক্ষে কারাম গাছের ডাল কেটে আনা হয় এবং তা ঘরের উঠানের মাঝখানে পোঁতা হয়। তারপর পূজা হয়, নাচগান হয় এবং কাহিনী পালাগানের ব্যবস্থা থাকে। কারাম উৎসব চলাকালীণ সময়ে অবিবাহিত যুবক-যুবতীরা উপবাস করে থাকে। নব বিবাহিতা মেয়েরা এ সময় শ্বশুর বাড়ী থেকে বাবার বাড়ীতে বেড়াতে আসে। মেয়েরা এ সময় শ্বশুর বাড়ী থেকে ফলমূল, কাপড়সহ নতুন ডালীতে করে নিয়ে আসে। এ জন্য কারাম উৎসবকে মিলন ও আনন্দের উৎসবও বলা হয়ে থাকে। এই উৎসবের মাধ্যমে বোনেরা ভাইদেরকে স্মরণ করে।
একটি প্রবাদ আছে, “আপনা কারাম ভাইকা ধারাম”। উৎসবশেষে কারাম ডালগুলো জলাভূমিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। কারাম ডাল হাতে ঘরে ঘরে নৃত্য গান চলাকালে পূর্ব প্রস্তুতি উপবাসকারী ছেলে ও ছেলে, মেয়ে ও মেয়ে একে অপর নতুন পোশাক পরিহিত অবস্থায় কারাম ডালকে সাক্ষী রেখে বন্ধ/বান্ধবী পাতার যা কারাম ডাইর নামে পরিচিত। এখানে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বন্ধু পাতানোর বাড়ীতে/পরিবারের বিয়ে চলবে না। একে অপর পরিবার নিজ ভাই বোন হিসাবে কড়া সমন্ধ্য থাকবে।
ডাল পূজা শুরু হওয়ার আগের রাত্রে অর্থাৎ অষ্টমীর রাত্রে নাচের আসরে গান করে-
‘আওয়ি কারাম ঘারে।
